তহবিল সংকটের কারণে দুই লাখ ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুর শিক্ষা এখন হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনিসেফ। টেকসই অর্থনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সব ধরনের সহায়তার সুযোগ ঝুঁকিতে পড়েছে, যার মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য জরুরি মৌলিক শিক্ষার সুযোগ হারানোর আশঙ্কা করেছেন তারা। ইতোমধ্যে ইউনিসেফ পরিচালিত লার্নিং সেন্টারগুলোর ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় বাংলাদেশি শিক্ষক চাকুরি হারাতে বসেছে।
রবিবার (২ জুন) কক্সবাজারে ইউনিসেফ কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এই তথ্য জানানো হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউনিসেফ কক্সবাজার অফিসের প্রধান এঞ্জেলা কার্নে বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় ইউনিসেফ পরিচালিত কার্যক্রমের জন্য মানবিক সহায়তার তহবিল উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে শরণার্থী শিবিরগুলোতে ইউনিসেফের সহায়তাপুষ্ট শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ভর্তি হওয়া স্কুলগামী শিশুদের ৮৩ শতাংশের শিক্ষার ওপর।
প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয়, নতুন তহবিল গঠন এবং নতুন করে কার্যক্রম সাজানোর নিরলস প্রচেষ্টা চালানোর পরেও তহবিল সংকটের কারণে ইউনিসেফকে কিছু কষ্টদায়ক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এর মধ্যে কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করা হোস্ট কমিউনিটির স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের সহায়তা স্থগিত করার মতো বিষয় রয়েছে। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সর্বমোট এক হাজার ১৭৯ জন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের ইউনিসেফের সঙ্গে চুক্তি শেষ হবে। এই স্বেচ্ছাসেবকেরা মূলত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সদস্য।
তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের মতো সিরিয়া, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পেও ইউনিসেফের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রেস ব্রিফিংয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সংকট মোকাবিলায় পাশে দাঁড়ানোর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা আরো জানায়, নতুন করে তহবিল পাওয়া গেলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানসম্মত শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সহায়তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
বার্মিজ ভাষা, গণিত, জীবন দক্ষতা ও সামাজিক মানসিক শিক্ষার উপর অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কেবল। যেখানে যুক্ত থাকবেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিক্ষকরা। এমনকি শিশুদের নতুন করে পাঠ্যবই দেওয়া থেকেও সরে আসার কথা জানিয়েছে কার্নে।
তিনি বলেন, পুরাতন বইগুলো শিক্ষাবর্ষ শেষে পুনরায় নতুন ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে।
এদিকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধের খবরে চাকরিরত স্থানীয় শিক্ষকরা কয়েকদিন ধরেই উখিয়ায় আন্দোলন করছেন। তারা সড়ক অবরোধ করে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার যান চলাচল ব্যাহত করছেন।
তাদের দাবি, রোহিঙ্গাদের রেখে স্থানীয়দের চাকরি থেকে সরানো হচ্ছে। এতে করে স্থানীয়রা আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
স্থানীয়দের চাকরির দাবিতে আন্দোলনকারী সাফফাত ফারদিন চৌধুরী বলেন, হোস্ট এরিয়া উখিয়া মগের মুল্লুক নয়, যখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নেবেন। হোস্ট কমিউনিটির টিচারদের অন্যায়ভাবে অপসারণের চেষ্টা করা হলে আমরা ছাড় দেব না। সব কিছুর ফান্ড থাকে; হোস্ট কমিউনিটির বেলায় ফান্ড থাকে না, এই খেলা বন্ধ করতে হবে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইউনিসেফ কর্মকর্তা এঞ্জেলা কার্নে বলেন, এখানে কোনো বৈষম্য নেই, এটা শুধুমাত্র তহবিল সংকটের কারণে নেওয়া সিদ্ধান্ত। আমাদের এখানে তিন হাজারের অধিক বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক কাজ করেন, যেখান থেকে শুধুমাত্র গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ ভুক্তরা থাকছেন না।
স্থানীয়দের চাকরি থেকে বাদ দিলে তার প্রতিক্রিয়া ভাল হবে না বলেই মনে করছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, এখানে যে চাকরিচ্যুতির বিষয় আছে। এতে আমাদের স্থানীয় লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১২-১৩ লাখ রোহিঙ্গার যে চাপ, তাতে স্থানীয়দের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারি তা এই ছোটোখাটো কিছু চাকরি দিয়ে। তারা যে এখানে আন্দোলন করছে, তার জন্য আমরা তো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছি।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচিতির অন্যতম মাধ্যম হলো তাদের নিজ ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশ সরকারের পলিসি বিরুদ্ধে।
“আমরা ইউনিসেফকে জানিয়েছি, সামগ্রিক বিষয়ে এবং সরকারের উপর মহলেও জানানো হয়েছে। তারা বলেছে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। যদি শিক্ষা কার্যক্রম ফের চালু হয় তবে ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি বিষয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী কমিশনার বলেন, এটাও আমাদের পলিসি-বিরুদ্ধ, কারণ আমরা চাই রোহিঙ্গারা ইংরেজি শিখুক।
রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী টি কে অং মাইয়েং বলেন, “লার্নিং সেন্টার বন্ধ হলে রোহিঙ্গা শিশুদের মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হবে। কারণ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় লার্নিং সেন্টারগুলো শিশুদের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় হয়ে আছে।